নিজস্ব প্রতিনিধি, কক্সবাজার ::
অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার শহরে। উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তারা কৌশলে জেলা শহরে ঢুকে পড়ছে বলে জানা গেছে। এভাবে তারা গোপনে রোহিঙ্গাদের ডিপো হিসেবে পরিচিত কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নিচ্ছে। বিজিবির কড়া পাহারায়ও থেমে নেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গা।
বর্তমানে কক্সবাজার শহরের কলাতলী, পাহাড়তলী ও ঝিলংজা ইউনিয়নের মুহুরি পাড়া এলাকায় অনেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা এসব এলাকায় তাদের স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু তারা আটকের ভয়ে পরিচয় গোপনসহ কারো সাথে কথা বলার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
মিয়ানমারের জামবনিয়ার এলাকার জামাল হোসেন এখন কক্সবাজার শহরের কলাতলীর বড়ছড়া গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন আমির নামে এক স্বজনের কাছে। জামাল হোসেন বলেন, প্রায় ২০ দিন আগে টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এরপর আশ্রয় নিয়েছিলাম টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে। এখন এক সপ্তাহ হলো বড়ছড়া গ্রামে আমিরের বাসায় থাকছি। আমির আমার কাছের আত্মীয়। তিনি বলেন, আমার সাথে নয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে প্রায় ১২ জন রোহিঙ্গা কক্সবাজার শহরে আসেন। এরপর যে যার মতো করে স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এখন কে কোথায় আছে জানিনা। তবে মিয়ানমারের খেয়ারিপ্যারাং থেকে আসা হামিদ ও কাওয়ারবিল থেকে আসা আবদুল্লাহ কলাতলীর এক স্বজনের বাসায় অবস্থান করছে বলে শুনেছি।
এদিকে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহযোগিতায় কথা হয় ঝিলংজা দক্ষিণ মুহুরি পাড়া এলাকায় অবস্থান করা ছেনুয়ারা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, প্রায় ২২ দিন আগে দালালের মাধ্যমে নাফ নদী হয়ে টেকনাফে উঠি। এরপর টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে অবস্থান করি তিনদিন। এখন প্রায় ১৭ দিন হচ্ছে মুহুরি পাড়ায় আব্দুল্লাহর বাড়িতে থাকছি। সঙ্গে আমার ছোট বোন আনোয়ারা বেগম ও তিন সন্তান রয়েছে। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সৈন্যরা। তাই আমরা ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল।
মিয়ানমারে পিতামাতা ও স্বজনদের হারিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ১৮ দিন আগে উখিয়ার কুতুপালং-এ আসেন নাপ্পুরার সাদেক। বর্তমানে তিনি মহেশখালীতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
কক্সবাজার শহরের ঝিলংজা ইউনিয়নের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন বলেন, তার ইউনিয়নের দক্ষিণ মুহুরি পাড়ায় নতুন করে রোহিঙ্গা আসা শুরু করেছে এক সপ্তাহ ধরে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় কয়েকশ’ রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করে আসছে। এখন নতুন করে আবারো রোহিঙ্গারা সেখানে অবস্থান নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫টি পরিবার বিচ্ছিন্নভাবে এই এলাকায় বসবাস করছে বলে তিনি জানান।
শহরের পাহাড়তলী এলাকার সমাজ সেবক সৈয়দ আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকাটি রোহিঙ্গাদের ডিপো হিসেবে পরিচিত। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পর থেকে পাহাড়তলীতে নতুন রোহিঙ্গাদের আনাগোনা বেড়েছে। রোহিঙ্গা স্বজনদের কাছে ঠাঁইও নিয়েছে অনেকেই। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা উখিয়া টেকনাফ হয়ে এখন শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজার লিংক রোডস্থ বিসিক সংলগ্ন বর্মাইয়া পাড়ায়ও রোহিঙ্গারা ঠাঁই নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এভাবেই রোহিঙ্গারা আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের খোঁজে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া, রামু পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদমসহ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আবদুর রহমান বলেন, শহরে নতুন কোনো রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে এমন খবর আমাদের কাছে নেই। যদি অবৈধভাবে কেউ আশ্রয় নেন তাহলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মনিটরিংও করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড় নদী পেরিয়ে বিজিবির নজর এড়িয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গাদের। নতুন আসা এসব রোহিঙ্গারা প্রথমে টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় নিলেও পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার শহর ও বান্দরবান জেলার বিভিন্নস্থানে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবারও শতাধিক রোহিঙ্গা এসেছেন টেকনাফের নাফনদী সীমান্ত পেরিয়ে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুরের মধ্যে আরাকানের খেয়ারিপ্যারাং এলাকা থেকে অন্তত ১৫ পরিবারের শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু এসেছে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে।
এদের মধ্যে আবদুল ওয়ারেছের ছেলে আবদুর রহিমের একটি চোখ নষ্ট। তার পিতাকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে এবং তার একটি চোখও চিরতরের জন্য নষ্ট করে দিয়েছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবারের ৬ সদস্যকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। তাদের সাথে পরিবারের ৪ সদস্যকে নিয়ে এসেছেন একই এলাকার দিল মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ ইউনুছ। তিনিও গুলিবিদ্ধ। এছাড়া আহত হয়ে পরিবারের ৩ সদস্য নিয়ে আবদুল হাই এবং চার সদস্য নিয়ে মোহাম্মদ ইলিয়াছও এসেছেন। তাদের সাথে ৩ শিশু সন্তনকে নিয়ে কুতুপালং এসেছেন জাহেদা বেগম। জাহেদা জানান, তার স্বামীকে সেনাসদস্যরা হত্যা করে তাকে ও সন্তানদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। এ কারণে আতংকে তিনি দেশ ছেড়েছেন। কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা ফাতেমা বলেন, বৃহস্পতিবার মিয়ানমার থেকে ১৫ পরিবারের শতাধিক রোহিঙ্গা এসেছে। তাদের দুরাবস্থা ও অসহায়ত্ব দেখে ক্যাম্পের বাসিন্দারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
তবে উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের বলেন, নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা উখিয়ায় আসতে পারছে না। ক্যাম্পের আশপাশসহ পুরো উখিয়ায় পুলিশের নজরদারি রয়েছে। তিনি বলেন, প্রায় ২০ দিন আগে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশে করে কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে সেদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফ বিজিবি ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, বিজিবির কড়া পাহারায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। তারপরও রাতের আঁধারে নৌকা নিয়ে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু বিজিবি তাদের প্রতিহত করছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আর গত দু’মাসে প্রায় ৩০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গারা এখন ক্যাম্প থেকে ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার শহর ও উপজেলা গুলোতেও। প্রশানের পক্ষ থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও বিভিন্ন অন্তর্জাতিক সংস্থার ভাষ্য মতে কক্সবাজারের বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে দশ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে। আর স্থানীয়দের মতে এর সংখ্যা ত্রিশ হাজারের অধিক।
পাঠকের মতামত: